অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস

 



আমাদের শ্রদ্ধেয় স্যার প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন। তিনি আমাদের গ্রামীণ ব্যাংকের অহংকার এবং বাঙালি জাতিরও অহংকার। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর একমাত্র নোবেল বিজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক। গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে বিদায়ি সরকার অনেক তির্যক মন্তব্য করেছে। এই ভয়ে বিগত ১৫ বছর গ্রামীণ ব্যাংকের এই মহান ব্যক্তিটি নিয়ে লিখতে গিয়ে অনেক সমস্যাও হয়েছে। অথচ এ মহান ব্যক্তিটির অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল কিন্তু প্রাণের গ্রামীণ ব্যাংক। এটা অমনি করে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এর পেছনে স্যারের অক্লান্ত পরিশ্রম ছিল। সদস্যদের সাক্ষরতা শিখিয়ে তাকে ঋণ দেওয়া, শিক্ষকের মতো ভূমিকা নিয়ে ঋণের মাধ্যমে কিভাবে স্বাবলম্বী করা যায় এবং তাকে কাজে লাগানো যায়, সেটা কিভাবে করতে হয় পরম মমতা দিয়ে আমাদের শিখিয়েছেন।

শুরুর ইতিহাস থেকে জানা যায় দারিদ্র্য বিমোচনের যুদ্ধে তাঁর সঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র যোগ দেয়। তিনি তখন অর্থনীতির প্রফেসর ছিলেন। সে সময় ইউনিভার্সিটির পাশের দারিদ্র্যপীড়িত জোবরা গ্রামে গবেষণা প্রকল্প হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্পটি হাতে নেন। ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে সারাক্ষণ পড়ে থাকতেন ওই গ্রামে। সাহায্য নয়, সহযোগিতা করা এই কর্মযজ্ঞের মন্ত্রে অনুপ্রাণিত করেছিলেন গ্রামবাসীকে। স্বল্প পুঁজিতে হরেক রকমের ব্যবসায় নামালেন গ্রামের ভূমিহীন-বিত্তহীনদের।জোবরা গ্রামের অনাবাদি জমিগুলো তেভাগা কর্মসূচির মাধ্যমে চাষাবাদের জন্য আনা হলো। সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর কথা শুনল এবং সফলতা পেল। প্রত্যেকের পারিবারিক অবস্থারও পরিবর্তন হলো। স্যানিটারি ল্যাট্রিন, গৃহনির্মাণ ঋণ, টিউবওয়েল বসানো, রাস্তাঘাট তৈরির মাধ্যমে সব কিছুর আমূল পরিবর্তন হলো। প্রফেসর ইউনূস তাদের কাছে মহান ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হলেন। জোবরা গ্রামের প্রকল্পটি সফলতা পাওয়ার পর টাঙ্গাইলের অজপাড়াগাঁয়ে এ কর্মসূচি স্থানান্তরিত হয়। সেখানেও প্রকল্পটি জনপ্রিয়তা পায়। সাফল্যের সঙ্গে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮৩ সালের অক্টোবর মাসে প্রকল্পের অবয়ব থেকে একটি পৃথক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তখন ব্যাংকের মালিকানা ৬০ শতাংশ সরকারের হাতে ছিল। আর ৪০ শতাংশ মালিকানা ছিল গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যদের হাতে। তখন অবশ্য এটা সরকারি ব্যাংক ছিল। পরবর্তী সময়ে ভূমিহীন ও বিত্তহীনদের ঋণ দেয়। যারা ঋণ নেয় তারাই ১০০ টাকার শেয়ার কিনে মালিকানা পায়। ফলে এটাকে সদস্যদের মালিকানা ব্যাংকও বলা হয়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, ব্যাংক পরিচালনা বোর্ডের ১২ সদস্যের মধ্যে ৯ জন গ্রামীণের সদস্যদের মাঝ থেকে, বাকি তিনজন সরকার থেকে নিয়োগ পান। ব্যাংকের চেয়ারম্যান সাধারণত সরকার নিয়োগ দিয়ে থাকে। গ্রামীণ ব্যাংক কিন্তু কোনো এনজিও নয়, এটা একটি বিশেষায়িত ব্যাংক। বর্তমানে দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ৫১টি ব্যাংক আছে। এরা শহর থেকে গ্রামে যেতে চায় না। শহরের চাকচিক্য থেকে ব্যাংকিং কার্যক্রম চালায়। তা ছাড়া সরকারি ব্যাংকে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক পেশিশক্তির প্রভাবে সুশাসনের যথেষ্ট অভাব। দালিলিক কাগজপত্রের জটিলতার কারণে কাঙ্ক্ষিত ঋণ থেকে বঞ্চিত হয়। সে জন্য গ্রামের জনগণ এদের কাছে যেতে পারে না। অন্যদিকে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ভূমিহীন দারিদ্র্য জনগোষ্ঠীকে ব্যাংকিং সুবিধা পৌঁছে দেওয়া এবং আর্থ-সামাজিকতার সঙ্গে সঙ্গে তারা যাতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে, নিজেরা যাতে দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে পারে—সেটাই গ্রামীণ ব্যাংকের মূল লক্ষ্য। প্রফেসর ইউনূস স্যারের দর্শন হলো ব্যাংক যাবে ঋণগ্রহীতার বাড়িতে। অর্থাৎ কর্মীরা ব্যাংকিং সুবিধা তার ঘরে পৌঁছে দেবে। এ কাজগুলো প্রফেসর ইউনূসের সৈনিকরা সততার সঙ্গে করে থাকে বিধায় গ্রামের মানুষের কাছে গ্রামীণ ব্যাংক খুবই জনপ্রিয় এবং আস্থার জায়গা। বর্তমানে দেশব্যাপী এর কার্যক্রম আছে। শাখার সংখ্যা দুই হাজার ৫৬৮টি। আমানতে ব্যালান্স ২৫ হাজার কোটি টাকা ও আদায়যোগ্য ঋণের ব্যালান্স ১৭ হাজার কোটি টাকা। আদায় হার ৯৭ শতাংশ। আদায়যোগ্য ঋণের তুলনায় আমানতের শতাংশ ১৫৩। গ্রামীণ ব্যাংকের আদলে বিশ্বের ৯৭টি দেশে এর কার্যক্রম চলছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হয়েছে গ্রামীণ আমেরিকা।

বিশ্বের বহু দেশের গুণীজন, সাংবাদিক ও ছাত্র-ছাত্রী আসেন এই গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর গবেষণা করতে, কিছু শিখতে ও জানতে। এ গবেষণাকাজের জন্য গ্রামীণ ব্যাংককে নির্ধারিত ফি দিতে হয়। বর্তমানে দেশে গ্রামীণ ব্যাংকের কাজের সফলতা দেখে অনেক সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক ক্ষুদ্র ঋণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এরাও ভালো সফলতা পাচ্ছে। বর্তমানে গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যসংখ্যা এক কোটি পাঁচ লাখ। অর্থাৎ চার কোটি ২০ লাখ জনগোষ্ঠী গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে জড়িত।

ইতিহাসের পাতা থেকে আমরা এটাও জানি, এই উপমহাদেশের আরেক নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০৫ সালে কালীগ্রাম পরগনায় দরিদ্র গ্রামীণ মানুষকে মহাজনের পীড়ন থেকে রক্ষা করতে সমবায়ী কৃষি ব্যাংক (কালীগ্রাম কৃষি ব্যাংক) স্থাপন করেন। সেখানে সুদের হার ছিল ১২ শতাংশ। তিনি ৮ শতাংশ সুদে টাকা ধার করে ব্যাংকের প্রাথমিক পুঁজি সরবরাহ করতেন। ব্যাংক ভালোই চলল, গরিব মানুষ উপকৃত হলো। এর প্রভাবে মহাজনরা ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হলেন। রবি ঠাকুরের কালীগ্রাম কৃষি ব্যাংক পরে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। রবি ঠাকুর কৃষি ব্যাংক করে প্রচুর সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি দমে যাননি। রবীন্দ্রনাথের কৃষি ব্যাংক ছিল বাংলাদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ। গ্রামীণের পরিধি বিশ্বব্যাপী। দুই মহান ব্যক্তির মহান সৃষ্টিধারায় বাঙালি জাতি উপকৃত হলো। ১৯১৩ সালে সাহিত্যে রবি ঠাকুর নোবেল পেলেন। 

অন্যদিকে একেবারে নিম্নস্তর থেকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন সাধনে এবং পৃথিবী থেকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দূরীকরণে গ্রামীণ ব্যাংকের সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৬ সালে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংককে যৌথভাবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্মান নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করে। নোবেল প্রাপ্তিতে হঠাৎ দেশ যেন জেগে উঠল। সারা বাংলাদেশের মিডিয়ায় খবরের শিরোনাম ছিল গ্রামীণ ব্যাংক। প্রিন্ট মিডিয়া কেউ কেউ নিউজ হেডলাইন করতে দেখা গেছে ‘বাংলাদেশ নোবেল পুরস্কার পেয়েছে’। সারা দেশ অসংখ্য ব্যানার-পোস্টারে ছেয়ে গেল প্রফেসর ইউনূস স্যারকে অভিনন্দন জানানোর প্রতিযোগিতায়। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপার ছিল স্কুল-কলেজ থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা এসেছিল স্যারকে অভিনন্দন জানাতে। সরকারদলীয় ও বিরোধীদলীয় মন্ত্রী-এমপিরাও এসেছিল শুভেচ্ছা জানাতে। আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলো ছিল খবর সংগ্রহে সরব। ধন্য বাংলাদেশ, ধন্য প্রফেসর ইউনূস, ধন্য গ্রামীণ ব্যাংক—সবার মুখে তা-ই ছিল। 


বিশ্ববাসী থেকে ক্রমান্বয়ে প্রশংসা আসতে শুরু করল। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে নরওয়ের একটি টেলিভিশন চ্যানেলে গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর প্রামাণ্যচিত্র প্রচারের পর থেকে প্রফেসর ইউনূস স্যারকে দেশে না বুঝে হেনস্তা করা শুরু হলো। তখন অনেকেরই সন্দেহ হয় এ কাজটি স্বার্থান্বেষী মহল উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করিয়েছে। পরে সংবাদ সম্মেলন করে সরকারি পর্যায়ে লোকজন প্রফেসর ইউনূস সম্পর্কে অশালীন ভাষায় আক্রমণ  শুরু করে। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে এ রকম বক্তব্যে পরিস্থিতি কেমন হয়? তখন আমাদের সদস্য পরিবারের হৃদয়ে যেন মারাত্মক রক্তক্ষরণ হয়েছিল। তখনকার অ্যাটর্নি জেনারেল বলেই ফেললেন, নোবেল পুরস্কার পাওয়ার কথা ছিল শেখ হাসিনা ও সন্তু লারমার। প্রফেসর ইউনূস পাওয়ার যোগ্য নন। তাঁদের কেউ কেউ নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য দাবিও উঠালেন। পরে মামলা-মোকদ্দমা হলো। প্রফেসর ইউনূসকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য আইনের আশ্রয় নিতে হলো। তাঁকে জোরপূর্বক ব্যাংক থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হলো।

সরকারের বোঝা উচিত—নোবেল পুরস্কার কোনো ব্যক্তির কৃপায় হয় না। যদি তা-ই হতো বিশ্বে কি ধনাঢ্য ব্যক্তির অভাব ছিল? যদি সে সুযোগ থাকত আমাদের দেশে কমপক্ষে ৫০টি নোবেল পুরস্কার আসত। কিন্তু বাস্তবতা স্বীকার করতে সমস্যা কোথায়? যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক নোবেল পুরস্কার পেয়েছে। দেশকে নতুন করে সম্মান এনে দিয়েছে। হাসিনা সরকার তা মানতে নারাজ। আমরা যে পুরস্কার প্রাপ্তির কারণে এক লাফে অনেক ওপরে উঠে গেছি সেটাও তাদের অনূভুতিতে আঘাত করেনি, দুর্ভাগ্য আমাদের। 

প্রফেসর ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক নোবেল পুরস্কার পাবে আমরা তা শুনে আসছিলাম ১৯৯৪ সাল থেকে। এটা হঠাৎ করে হয়নি। প্রতিবছরই বিবেচনায় তাঁর নাম আসত। এরই মধ্যে অনেক আন্তর্জাতিক পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন। পাশের দেশ ভারত থেকে প্রফেসর ইউনূস তিনটি সেরা পুরস্কার পেয়েছেন। যেমন—ইন্দিরা গান্ধী পুরস্কার, মহাত্মা গান্ধী পুরস্কার, বিশ্বভারতী রবীন্দ্রনাথ পুরস্কার। সেটা কি অর্থের বিনিময়ে হয়েছে? আমেরিকার সেরা দুটি পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন—প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম এবং কংগ্রেস গোল্ড মেডেল পুরস্কার। তা ছাড়া জাপান, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, ফ্রান্স, ব্রিটেন, জার্মানি, সুইডেন, ইতালি, ফিলিপাইন, দক্ষিণ কোরিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে তিনি পুরস্কার পেয়েছেন। বাংলাদেশে তিনি পেয়েছেন স্বাধীনতা পুরস্কার। রাষ্ট্রপতি পুরস্কারও পেয়েছেন। গ্রামীণ ব্যাংকও স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার পেয়েছে।

বিশ্বের অনেক দেশেই স্যারের মূল্যবান বক্তব্য শোনার জন্য তাঁকে নিমন্ত্রণ করা হয়। যারা নিমন্ত্রণ করে তারা বিমানভাড়া থেকে শুরু করে যাবতীয় খরচ বহন করে। তিনি বাংলা ও ইংরেজির সুবক্তাও বটে। কিন্তু আওয়ামী সরকার তা মূল্যায়ন করেনি।

তিনি ভারতের লোকসভার যৌথ অধিবেশনে বক্তব্য রেখেছেন। বছর দুই আগেও আসামের রাজ্যসভায় বক্তব্য রেখেছেন। বার্লিন দেয়াল ধ্বংসের ২০তম বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে জার্মানিতে যখন বক্তব্য রাখেন তখন ইউরোপের সব সরকারপ্রধান মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে তার বক্তব্য টিকিট কেটে শুনছিলেন। তিনি সারা বিশ্বের সামাজিক ব্যবসারও উদ্যোক্তা। সামাজিক ব্যবসা নিয়ে বিভিন্ন দেশে সম্মেলনও করে যচ্ছেন। 

তিনি অত্যন্ত সাদামাটা জীবনযাপন পছন্দ করেন। যেহেতু গ্রামীণ ব্যাংক গরিবের ব্যাংক, অযথা আমাদের খরচ করতে অনুমতি দেয়নি। তিনি যখন এমডি ছিলেন কাঠের চেয়ারে বসতেন। এ ধারা ম্যানেজার থেকে শুরু করে সবার ক্ষেত্রে অদ্যাবধি চালু আছে।

কিন্তু আওয়ামী লীগের লোকেরা তাঁকে অর্থপাচারকারী, সুদখোর, ঘুষখোর আরো কত কী উপাধি দিলেন। সাবেক অর্থমন্ত্রীও যাচ্ছেতাই মন্তব্য করলেন। এর প্রতিবাদে ফিল্ড পর্যায়ে আমরা মানববন্ধনও করি। সরকার কিছুই তোয়াক্কা না করে অনবরত মিথ্যাচার করে যাচ্ছিল। এমনকি পদ্মা সেতুর ব্যাপারে যাচ্ছেতাই মন্তব্য করেছে। মনে হচ্ছে যেন শেখ হাসিনা নোবেল না পাওয়ায় এত যন্ত্রণা। 

যে দেশে গুণীজনের সম্মান নেই, সে দেশে গুণীজন জন্মায় না। সেটা আমাদের বুঝতে সময় লাগল এটাই সবচেয়ে বড় আফসোস।

বিগত ১৫ বছর আমরা স্যারকে দেশের কাজে লাগাতে পারিনি। স্যার বলেছিলেন, সরকারকে সহযোগিতা করতে চাই, কিন্তু সহযোগিতা না নিয়ে মামলা দিয়ে ব্যস্ত রাখল। এতে ক্ষতি কার হলো, অবশ্যই বাংলাদেশের।

নরওয়েতে সম্প্রসারিত প্রামাণ্য চিত্র নিয়ে জোরালো তদন্ত করা হলো অধ্যাপক মনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে। গ্রামীণ ব্যাংকে কোনো আর্থিক অনিয়ম হয়নি, তা তিনি রিপোর্টে উল্লেখ করলেন এবং গ্রামীণ ব্যাংক সবচেয়ে কম সুদ নেয় এটাও রিপোর্টে উল্লেখ ছিল। তাইতো গ্রামীণ ব্যাংক হাজারো প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান। 

এই উপমহাদেশে রবি ঠাকুর, মাদার তেরেসা, অমর্ত্য সেন, প্রফেসর আবদুস সালাম, অং সান সু চি এবং আমাদের প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস নিজ নিজ ক্ষেত্রে অবদানের জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। কারো চেয়ে কেউ কম নন। তাই বলে নিজের দেশের নোবেল বিজয়ীকে বাদ দিয়ে অন্য দেশের নোবেল বিজয়ীকে দিয়ে একুশের বইমেলা উদ্বোধন করতে হবে? সেটাও আমাদের দেখার সৌভাগ্য হয়েছে শেখ হাসিনা সরকারের সময়। এভাবে পদে পদে আমাদের নোবেল বিজয়ীকে অপমানিত করে তিনি কি সম্মানিত হয়েছেন?

শেখ হাসিনা সরকারের সময় অধ্যাপক সাইফুল মজিদকে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস স্যারের কী কী অনিয়ম আছে লাখ লাখ টাকা খরচ করে অডিট করালেন, কিন্তু কিছুই পাননি। তিনি সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যস্ত ছিলেন। কোনো উন্নয়নমূলক কাজ করতে দেখা যায়নি। তাঁকে নিয়ে ব্যাংকে বহু সমালোচনা আছে। তিনি ব্যাংকের অনেক ফান্ড তছরুপ করেছেন। 

কেউ কেউ বলেন, উনি আরেক আব্দুল হাই বাচ্চু মত ছিলেন। ওনার আমলেই গ্রামীণ ব্যাংক থেকে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের ছবি অফিস অর্ডার করে নামিয়ে ফেলা হয়। স্বৈরাচার সরকার পতনের পরপরই স্যারের প্রিয় কর্মীরা গ্রামীণ ব্যাংকের সব কার্যালয়ে স্যারের ছবি এখন আবার টাঙিয়েছে। এ ছবি আমাদের শক্তি দেয়, উৎসাহ-অনুপ্রেরণা জোগায়। সততা শেখায়। ছবি অপসারণের বিষয়টি সহজভাবে কেউ তখন মেনে নেয়নি। সবার মনে ভীষণ দাগ লেগেছিল। আমাদের ব্যর্থতা প্রতিবাদ করে ব্যর্থ হয়েছি। এই সাইফুল মজিদ কী কী অনিয়ম গ্রামীণ ব্যাংকে করেছেন, তা সংবাদপত্রে আমার লেখার ইচ্ছে আছে। ব্যাংকের অর্থ ব্যয় করে তিনি হিরো সাজতে চেয়েছিলেন, আজ তিনি ব্যাংকে অবাঞ্ছিত। গ্রামীণের প্রতিটি কর্মীর হৃদয়ে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস গেঁথে আছেন এবং তা থাকবেন আজীবন। কেউ তাঁর সম্মান কেড়ে নিতে পারবে না। স্যার আমাদের শিখিয়েছেন ‘ঋণ আমাদের মৌলিক অধিকার’, প্রযুক্তির পিঠে সওয়ার হয়ে দেশ একদিন এগিয়ে যাবে, ভালো কাজ করতে হলে ক্রমাগত ভাবতে হবে। আমরা এগুলো ধারণ করে আছি এবং থাকব। আজ দেশের এ ক্রান্তিলগ্নে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হওয়ায় আমরা গর্বিত। তাঁর হাতেই আমাদের দেশ সুরক্ষিত থাকবে, গতি হারাবে না প্রিয় মাতৃভূমি। আশা করি, দেশবাসী সবাই মিলে স্যারকে সহযোগিতা করবে। আমরা স্যারের সহকর্মী হিসেবে তাঁর সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি।


Post a Comment

0 Comments